নিচের গল্পটা সম্ভবত সবাই শুনেছেন –

ফুটন্ত পানিতে একটা ব্যাঙকে ছেড়ে দেয়া হলে সেটা পালানোর চেষ্টা করবে।

কিন্তু ব্যাঙটাকে যদি সাধারন তাপমাত্রার পানিতে রেখে পানির তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়?

এবার ব্যাঙ তার জায়গাতেই থাকবে। পালানোর চেষ্টা করবে না। খাপ খাইয়ে নিতে থাকবে বাড়তে থাকা তাপমাত্রা সাথে। যদি যথেষ্ট ধীরগতিতে তাপমাত্রা বাড়ানো হয় তাহলে একসময় পানি ফুটতে শুরু করলেও ব্যাঙ আর পালাতে চেষ্টা করবে না।পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে একসময় ব্যাঙটা জ্যান্ত ফ্রাই হয়ে যাবে।

একশো বছরের বেশি সময় ধরে এই রূপক গল্পটা নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আসলে কি ব্যাপারটা সত্য?

প্রায় দেড়শ বছর আগে জার্মান ফিযিওলজিস্ট ফ্রেইডরিখ লিওপোল্ড গল্টয ব্যস্ত ছিলেন বৈজ্ঞানিক ভাবে মানুষের আত্মা বা রূহের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার খোঁজে। বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করে গল্টয বোঝার চেষ্টা করছিলেন আত্মা বা রূহ আসলে কোথায় থাকে। এমনই একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিল Boiling Frog।

গল্টয দেখলেন যদি কোন সাধারন ব্যাঙকে পানিতে রেখে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ানো হয় তাহলে পানির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হবার পরই ব্যাঙ পানি থেকে বের হবার পথ খুজতে থাকে। ২৫ ডিগ্রির পর তাপমাত্রা যতোই বাড়তে থাকে ব্যাঙের অস্থিরতা ততোই বাড়তে থাকে। যদি কোন কারনে সে পানি থেকে বের হতে না পারে তাহলে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রার পর ধনুষ্টংকার রোগীর মতো আড়ষ্ট শরীরে ব্যাঙটা মারা যায়।

কিন্তু যদি কোন ব্যাঙের মগজ সরিয়ে কৃত্রিমভাবে তার শরীরকে বাচিয়ে রেখে একই পরীক্ষা করা হয় তাহলে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ উল্টো ফলাফল। তাপমাত্রা যতোই বাড়ানো হোক না, ব্যাঙের মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। একসময় সেটা ফ্রাইড হয়ে যায়। যে ব্যাঙের মস্তিস্ক আংশিকভাবে অপসারন করা হয়েছে কিংবা যেটার স্পাইনাল কর্ডের বিভিন্ন জায়গায় কেটে দেয়া হয়েছে – সেগুলোর ক্ষেত্রেও পাওয়া যায় একই ধরনের রেসাল্ট।

সুতরাং Boiling Frog এর স্ট্যান্ডার্ড যে গল্পটা আমরা শুনে আসছি সেটা আসলে পুরোপুরি সঠিক না। আপনি যদি ফুটন্ত পানিতে কোন ব্যাঙ ছেড়ে দেন তাহলে সেটা মারা যাবে। কোন ভাবে বেচে গেলেও চরমভাবে আহত হবে। আর যদি সাধারন তাপমাত্রার পানিতে রেখে আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়াতে থাকেন তাহলে একসময় ব্যাঙ পালানোর চেষ্টা করবে।

ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকা পানিতে একটা ব্যাঙ নির্বিকার ভাবে বসে থাকবে,

ক) যদি সে মস্তিস্কহীন হয় (আংশিক বা সম্পূর্ণ), অথবাখ) যদি তার মেরুদন্ডে সমস্যা থাকেআর যদি কোন ব্যাঙকে যথেষ্ট পরিমানে নেশাসৃষ্টিকারী অথবা চেতনানাশক ওষুধ দেয়া হয় তাহলেও একই রকম ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

ভুল হওয়া সত্ত্বেও Boiling Frog এর গল্পের জনপ্রিয়তা এবং এতোদিন ধরে টিকে থাকার কারন সম্ভবত রূপক গল্প হিসেবে এর সার্থকতা। ক্রমবর্ধমান অন্যায়, অবিচার, নৈরাজ্যের মুখে মানব সমাজের সামস্টিক জড়তাকে উপস্থাপনে, এই গল্প ব্যবহৃত হয়েছে গত দেড়শো বছর ধরে। আর যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে ফুটন্ত ব্যাঙের গল্প রূপক হিসেবে দারুন। তবে বাস্তবতা হল, মানুষ ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকা পানিতে ছেড়ে দেয়া ব্যাঙের মতো না।

যখন শিশুদের পাঠ্যসূচি থেকে মিডিয়া, সব জায়গায় আপনার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুনবেন – যখন দেখবেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে পত্রিকার প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে আপনার বিশ্বাসের, আপনার পরিচয়ের বিভিন্ন অংশকে অশুভ কোন কিছুর মতো করে তুলে ধরা হচ্ছে – যখন দেখবেন আপনার বিশ্বাসের বিরোধিতা করাই সাধারন, প্রচলন এবং প্রথায় পরিণত হয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবে।

যখন আপনি সীমান্তের ওপার থেকে গরুর মাংশ খাবার কারনে নিয়মিত লাশ ফেলার কাহিনী শুনবেন – যখন দেখবেন আহমেদাবাদ, আসানসোল, আসাম আর আসিফাকে, যখন দেখবেন গুজরাটের কসাই, অযোধ্যার উন্মত্ত যোগী, জ্বলতে থাকা কাশ্মীর, হিন্দুত্ববাদের আস্ফালন আর বাড়তে থাকা আগ্রাসনকে – যখন দেখবেন প্রকাশ্যে অখন্ড ভারতের ডাক দেয়া হচ্ছে – তখন স্বাভাবিক ভাবেই আপনি বুঝবেন পানির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি বেশ আগেই ছাড়িয়েছে। তখন আপনি প্রাণপণে চেষ্টা করবেন ফুটন্ত পানি থেকে বের হবার। এটাই স্বাভাবিক। এটাই মানুষের ইন্সটিঙ্কটিভ রিঅ্যাকশান।

কিন্তু আপনি যদি মস্তিস্কহীন হন; যদি ফিরিঙ্গিদের আঁকিবুঁকি করা কাল্পনিক মানচিত্র, তাদের ধরিয়ে দিয়ে যাওয়া পতাকা আর গান, একটা অসংজ্ঞায়িত চেতনা, একটা কাল্পনিক রেখার একদিকের মানুষের রক্তের দাম রেখার অন্যদিকের মানুষের রক্তের চাইতে দামি হবার মতো বিশ্বাসগুলোকে জায়গা দেয়ার জন্য আপনার মাথা থেকে মগজ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আপনি ফেলে দিয়ে থাকেন – তাহলে নিশ্চিতভাবেই আপনার কোন প্রতিক্রিয়া হবে না।

যদি নেশাতুর হন – কিভাবে আরও বেশি জিনিসের মালিক হওয়া যায়, কিভাবে আরও বেশি, আরও বড়ও কেনা যায়, পাওয়া যায় – কিভাবে আর বেশি জনের সাথে শোয়া যায় – কিভাবে আরো বেশি জনের কাছে কাঙ্ক্ষিত হওয়া যায় – কিভাবে আরো বেশি মানুষের কাছে পরিচিত বা সম্মানিত হওয়া যায় – এই আসক্তিতে বুঁদ হয়ে থাকেন – যদি আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন আইপিএল, বিপিএলের এর সস্তা নেশায়, কিংবা সস্তায় নিজেদের বেচে বেড়ানো শরীরগুলোর মাদকতায় – তাহলেও আপনার কোন বিকার হবে না। পানি ফুটতে থাকবে, শরীরে ফোস্কা পড়ে যাবে কিন্তু আপনি কাঁচ-চোখে ভাবলেশহীন ভাবে ঢুলতে থাকবেন।

কিংবা যদি মেরুদণ্ডহীন হয়ে থাকেন – যদি কোনমতে বেচে থাকা, কোন মতে টিকে থাকা, কোনমতে নিজেকে রক্ষা করা, যেভাবে সবকিছু চলছে সেভাবে চলতে থাকা আর সাথে মানিয়ে নেয়াকে আপনি অস্তিত্বের উদ্দেশ্য বানিয়ে নেন – যদি মাসলাহাত, হিকমাহ, আকাবীর আর বাস্তবতার দোহাই দিয়ে মাটিয়ে মাথা ঠেকিয়ে পথচলাকেই আপনি সমাধান বলে গ্রহন করে থাকেন, সেক্ষেত্রে মাথা তুলে বাস্তবতাকে দেখার সুযোগ আপনার হবে না। নিজের পোড়া চামড়ার গন্ধ নাকে আসবে হয়তো, কিন্তু – আজ পাশের বাড়িতে রান্না ভালো হয়েছে – এই বলে নিজেকে বুঝ দিতেও সমস্যা হবে না।

কারন মানুষ ব্যাঙের মতো না। মানুষ হল ক্রমশ উত্তপ্ত পানিতে ছেড়ে দেওয়া মস্তিস্কহীন, মেরুদন্ডহীন, নেশাগ্রস্থ ব্যাঙের মত।

গল্টযের এক্সপেরিমেন্ট ছিল আত্মার অবস্থান নিয়ে। আত্মা কোথায় থাকে তিনি খুজছিলেন। কিন্তু কেন জানি মনে হয় এই সময়ে, এই জায়গাটাতে এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। প্রশ্ন তো অপ্রাসঙ্গিকই, কৌতুহলটাও অপ্রাসঙ্গিক। যে প্রশ্নটা করা যায় তা হল –

মস্তিস্কহীন, মেরুদন্ডহীন, নেশাতুর ব্যাঙগুলো যখন মরে ভাসতে শুরু করবে তখন কি বলা যাবে এই পরিণাম তাদের প্রাপ্য ছিল না?

তখন কি বলা যাবে এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত ছিল?

ফুটন্ত পানি, ব্যাঙ এবং আমরা
By Asif Adnan
https://chintaporadh.com/id/8162

Leave a comment

I’m Mustakin Rahman

Welcome to Great poetry, This is my personal blog. I’ll share here my experience and my creativity. I’m a student who learned the mystery of the world. I want to conquered the unconquered, to see the unseen and learn moreover. I feel extra ordinary romance for that.

Let’s connect

Design a site like this with WordPress.com
Get started