১৭৯৮ সালে জুলাইয়ে ফরাসি জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন মিসরে অভিযান চালান তখন সঙ্গে কেবল ১০ হাজার সৈন্যই নিয়ে যাননি; বরং সঙ্গে নিয়েছিলেন ১৫০ বিজ্ঞানীও। ওই সামরিক অভিযানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। এমন সাতটি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার।


এক প্রত্নতাত্ত্বিক বলেন, সাভাঁ হিসেবে পরিচিত এ বিজ্ঞানীদের কাজ ছিল গবেষণা ও সম্পদ আত্মীকরণ।


এক মাস পরই, ১৭৯৮ সালের ২৩ আগস্ট কায়রোর এক বিলাসবহুল প্রাসাদে প্রথম সভার আয়োজন করে বিজ্ঞানবিষয়ক সংগঠন মিসর ইনস্টিটিউট। এ সভায় নেপোলিয়ন সংগঠনটির প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। বিজ্ঞান বিষয়ক এ সংগঠনটি আজও টিকে আছে।

মিসরের প্রাকৃতিক সম্পদ, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ফ্রান্সের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন। তিনি সাভাঁদের রুটি তৈরির চুলা ও নীল নদের পানি বিশুদ্ধকরণের মতো কাজে গুরুত্ব দিতে বলেন।

পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা থাকায় সেসময় এ ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করা বেশ দুরূহই ছিল। বিজ্ঞানীদের এ কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে যখন তাঁদের বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামবাহী জাহাজ মাঝ সমুদ্রে ডুবে যায়। মিসরে টানা কয়েকটি অভিযানে পরাজয়ের পর নেপোলিয়ন ১৭৯৯ সালে ফ্রান্সে ফিরে যান এবং বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীকে মিসরেই রেখে আসেন।

সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রকৌশলী, গণিতবিদ, প্রকৃতিবিদ ও অন্য বিজ্ঞানীরা তিন বছরের মতো সময় ব্য়য় করে জরিপ চালান, তথ্য সংগ্রহ করেন এবং পুরাকীর্তি থেকে শুরু করে মমি এবং পাশ্চাত্যের কাছে অজানা প্রাণী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।

তাঁদের এ কাজগুলোর কারণে বেশ কয়েকটি অভিনব আবিষ্কার সামনে আসে, প্রত্নতত্ত্বের মতো বিজ্ঞান আনুষ্ঠানিক রূপ পায় এবং মিসরের প্রতি সারা বিশ্বের আগ্রহ তৈরি হয়।

নেপোলিয়নের মিসর অভিযানে উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো হলো—

নেপোলিয়নের মিসর অভিযান যে ৭ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব করেছিল
১. রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো বিপরীতমুখী হয়
রসায়নবিদ ক্লদ–লুই বার্থোলের বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার আগে, রাসায়নিক বিক্রিয়া বিপরীতমুখী হতে পারে—এ ধারণাটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ছিল না।

তবে বার্থোলে এ ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করার সপক্ষে প্রমাণ খুঁজে পান। ওই সময় তিনি ন্যাট্রোন উপত্যকার হ্রদে লবণ জমা হওয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন।

হ্রদের চুনাপাথরগুলোর ওপর প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া লবণ জমা হচ্ছিল। ন্যাট্রোন নামে পরিচিত এ লবণ মিসরীয়রা মমি করা মৃতদেহ সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহার করত। এটি পরিবেশ থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে চর্বি দ্রবীভূত করে।

বার্থোলে খেয়াল করেন, চুনাপাথরের ক্যালসিয়াম কার্বোনেট লবণের সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে সোডিয়াম কার্বোনেট সমৃদ্ধ ন্যাট্রোন লবণ তৈরি করে।

রসায়নবিদেরা জানতেন, পরীক্ষাগারে ঠিক একই বিপরীত বিক্রিয়া সম্ভব। এতে বার্থোলে বুঝতে পারেন, বিপরীত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব। বিক্রিয়াটি কোন দিকে সংগঠিত হবে সেটি নির্ভর করে তাপ ও এর মধ্যে একটি পদার্থের পরিমাণের ওপর।
নেপোলিয়নের মিসর অভিযান যে ৭ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব করেছিল
২. প্রত্নতত্ত্ব আনুষ্ঠানিক রূপ পায়
নেপোলিয়নের সময়টায় প্রত্নতত্ত্ব আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান ছিল না। বেশির ভাগ সাভাঁরই পুরাকীর্তি নিয়ে খুব কম অভিজ্ঞতা ছিল। এখনো বালির নিচে অনেক দেব মন্দির রয়েছে যা এখনো খুঁড়ে বের করা হয়নি।

মিসরের প্রাচীন সমাধিসৌধগুলো দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন শিল্পী ও লেখক দমিনিক ভিভাঁ দেনোঁ। তিনি নেপোলিয়নের সঙ্গে ফ্রান্সে গিয়েই তাঁর বর্ণনা ও আঁকা ছবি বই আকারে প্রকাশ করেন। বইটির নাম ‘ট্রাভেলস ইন আপার অ্যান্ড লোয়ার ইজিপ্ট’।

নেপোলিয়নের অভিযানের সময় পর্যটকেরা মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া, কায়রো ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল সম্পর্কে জানতেন। ওই সময় পিরামিড এবং মানুষের মুখ, সিংহের দেহ এবং ঈগলের ডানা বিশিষ্ট দেবতা স্ফিংক্স জনপ্রিয় ছিল। তবে মিসরের উঁচু অংশ এতটা পরিচিত ছিল না।

তবে সাভাঁদের আগমনের পর চিত্র বদলে যায়। দেনোঁ তাঁর বইয়ে বলেন, ‘হঠাৎ পুরো সেনাবাহিনী এক সঙ্গে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়…এবং আনন্দে হাততালি দেয়।’

দেনোঁর আঁকা থিবস, এসনা, এদফু এবং কারনাকের মন্দির এবং ধ্বংসাবশেষের ছবি ও বিবরণ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলোর অনেক ছবিই ফ্যাশনেবল পেইন্টিংয়ে রূপ দেওয়া হয় এবং সাজসজ্জার কাজে ব্যবহার করা হয়।

সমাধিস্তম্ভগুলোর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য আরও দুটি কমিশন মিসরে ফেরত পাঠানো হয়।

নেপোলিয়নের স্থপতি ও প্রকৌশলীরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগুলোর চিত্র তৈরি করেন এবং বেশ কয়েকটি সমাধিস্তম্ভ পরিমাপ করেন। অন্যরা পিরামিডের মাপ নেওয়ারও চেষ্টা করে।
নেপোলিয়নের মিসর অভিযান যে ৭ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব করেছিল
৩. কীটপতঙ্গের শ্রেণিবিন্যাস
ফ্রান্সে ফেরত যাওয়ার পর মিসর থেকে আনা দেড় হাজার প্রজাতির কীটপতঙ্গকে সংগঠিত উপায়ে শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজন বোধ করেন জুলস সিজার স্যাভিনি। তখন এক প্রজাতির পতঙ্গ থেকে অন্য প্রজাতি পৃথক করার কোনো নিয়মতান্ত্রিক উপায় ছিল না। তাই স্যাভিনি একটি উপায় আবিষ্কার করেন।

কীটপতঙ্গগুলোর মুখের আকৃতি দেখেই এগুলোকে বেশ কিছু প্রজাতিতে বিভক্ত করেন স্য়াভিনি। তিনি হাজারটিরও বেশি নমুনার ছবি আঁকেন। মাত্র ২১ বছর বয়সেই তরুণ এ উদ্ভিদবিদ মিসরে এসে কৃমি, মৌমাছি, মাকড়সা, শামুক এবং মাছির মতো অমেরুদণ্ডী প্রাণী সংগ্রহ করেন। তিনি স্টারফিশ, প্রবাল এবং সামুদ্রিক অর্চিনের নমুনাও সংগ্রহ করেন। তাঁর শ্রেণিবিন্যাসের বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়া আজও প্রচলিত।
নেপোলিয়নের মিসর অভিযান যে ৭ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব করেছিল
৪. নতুন প্রজাতির কুমির
আঁতোয়া জিওফ্রে সেন্ট–হিলেয়ার নিশ্চিত ছিলেন নীল নদে দুই প্রজাতির কুমির রয়েছে। জিওফ্রেও বিভিন্ন প্রাণি সংগ্রহ করতেন। মিসরে থাকার সময় তিনি বাদুড়, বেজি, কচ্ছপ এবং আরও কিছু প্রাণি নিয়ে গবেষণা করেন।

জিওফ্রের এতসব প্রজাতি ব্যবচ্ছেদ ও সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন কারণ তিনি ১১ বছরের একটি ছেলেকে দাস হিসেবে কিনে নিয়েছিলেন। ছেলেটিকে তিনি তাঁর কাজে সহায়তা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেন।

জিওফ্রে এত বেশি প্রাণি ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন যে তিনি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির মধ্যে একই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া শুরু করেন। এ পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি ‘ইউনিটি অব প্ল্যান’ নামের আধা বিবর্তনীয় ধারণা দেন। কয়েক দশক পর চার্লস ডারউইন একই ধারণার কথা উল্লেখ করেন।

জিওফ্রের এ তত্ত্ব অনেক বিজ্ঞানীই মেনে নিতে পারেননি। এমনকি তিনি মিসর থেকে নেওয়া মমি করা ভিন্ন প্রজাতির কুমিরও ব্যবচ্ছেদ করে প্রমাণ দেখানোর চেষ্টা করেন।

এ কুমিরটির চোয়াল নীল নদের কুমিরের চোয়াল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে দাবি করেন জিওফ্রে। এ ছাড়া এ কুমিরটি তুলনামূলক কম হিংস্র ছিল।

তবে তাঁর সহকর্মীরা কুমিরটিকে ভিন্ন প্রজাতির বলে মানতে চাননি। এর ২০০ বছর পরে জীববিজ্ঞানী ইভন হেক্কালা এবং একদল গবেষক আধুনিক কুমিরের ডিএনএ ও জিওফ্রের আবিষ্কার করা কুমিরের মমির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখেন। তাঁরা দেখতে পান নীল নদে আসলেই দুই ধরনের কুমিরের বিচরণ ছিল—ক্রোকোডাইলাস নাইলোটিকাস ও ক্রোকোডাইলাস সুকুস।
চক্ষুবিদ্যার আবির্ভাব
নেপোলিয়নের সঙ্গে থাকা ফরাসি চিকিৎসকেরা মিসরে অপরিচিত এক রোগের দেখা পান। এর মধ্যে একটি রোগ তাঁদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এর নাম দেওয়া হয় মিসরীয় চক্ষুরোগ যা এক ধরনের সংক্রামক রোগ। এতে আক্রান্ত হলে চোখ চুলকাতে পারে, ফুলে যেতে পারে এবং দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত হারাতে পারে।

এ রোগটির প্রাদুর্ভাব এতই বেড়ে যায় যে ইউরোপের চিকিৎসকেরা এ রোগ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। জিওফ্রে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক সপ্তাহ দৃষ্টিশক্তিহীন ছিলেন।

ততদিন পর্যন্ত চক্ষুবিদ্যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কোনো আনুষ্ঠানিক শাখা হয়ে ওঠেনি। তবে এ রোগের উৎস খুঁজে পেতে গবেষণার ফলেই এটি এক নতুন শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

অবশেষে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ভেচ আবিষ্কার করেন সংক্রমিত চোখের পিচুটি থেকে এ রোগ ছড়ায়। ভেচ এ রোগের প্রতিকারের উপায় ও চিকিৎসা বের করেন যা আজও চক্ষুবিদ্যার ইতিহাসের মাইলফলক।
নেপোলিয়নের মিসর অভিযান যে ৭ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব করেছিল
৬. হায়ারোগ্লিফ পড়ার কৌশল আবিষ্কার
মিসরের বিভিন্ন স্তম্ভের গায়ে আঁকা চিত্র—হায়ারোগ্লিফ—কয়েক শতক ধরেই মানুষের কাছে অজানা ছিল। কেউই তা পড়তে পারতো না। মিসর অভিযানের সময় ফরাসিরা যখন দ্য রোজেটা স্টোনের খোঁজ পান তাঁরা বুঝতে পারেন হায়ারোগ্লিফ অনুবাদে এটি ব্যবহার করা যাবে।

হায়ারোগ্লিফগুলো বোঝার কারণে পণ্ডিতেরা অন্যান্য প্রাচীন মিসরীয় গ্রন্থ এবং স্তম্ভগুলোর ওপর লেখা পড়তে পারেন।

১৮০১ সালে ব্রিটিশরা ফ্রান্সসের আত্মসমর্পণের সময় সাভাঁদের সংগৃহীত বেশ কয়েকটি পুরাকীর্তি নিয়ে যায়। এর মধ্যে দ্য রোজেটা স্টোন নামে একটি ফলকও ছিল।

সে পাথর খণ্ডে মিসরীয় হায়ারোগ্লিফে তিনটি লেখা খোদাই করা ছিল—একটি ছিল মিসরীয় হায়ারোগ্লিফে, একটি হায়ারোগ্লিফ থেকে আসা মিসরীয় বক্র বর্ণ এবং অন্যটি ছিল প্রাচীন গ্রিক বর্ণে। এ তিনটি লেখার মধ্যে মিল থাকায় গবেষকেরা গ্রিক ভাষার মাধ্যমে হায়ারোগ্লিফ ব্যাখ্যা করেন।

হায়ারোগ্লিফ ব্যাখ্যা করার জন্য ফরাসি পণ্ডিত জ্যঁ ফ্রাসোয়াঁ চ্যাম্পোলিয়নের দুই দশকের মতো সময় লেগেছিল। বর্তমানে রোজেটা স্টোন ব্রিটিশ জাদুঘরে রয়েছে।

নেপোলিয়নের মিসর অভিযান যে ৭ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব করেছিল
৭. দ্রুত গতির ছাপা প্রক্রিয়ার জন্য খোদাই যন্ত্রের আবিষ্কার
সাভাঁর ফ্রান্সে ফেরত যাওয়ার সময় কয়েক খণ্ডে লেখা বই ‘ডেসক্রিপশন দে এজিপ্ট’ বা ‘মিসরের বর্ণনা’ নামের একটি ৭ হাজার পৃষ্ঠার বই লেখেন। এ বই ছাপানোর জন্য খোদাইয়ের কাজের শ্রম কমাতে প্রকৌশলী নিকোলাস জ্যাকস কোঁৎ একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরি করেন।

শত শত ছবি ছাপার জন্য খোদাইকারীদের প্রথমে তামার পাতে তা স্থানান্তর করতে হতো। কোঁৎ–এর তৈরি যন্ত্রে আকাশ ও মেঘের মতো চিত্র খোদাই করা যেত। এতে যে কাজে ছয় থেকে সাত মাসের সময় লাগার কথা তা কেবল কয়েকদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়েছিল।

Leave a comment

I’m Mustakin Rahman

Welcome to Great poetry, This is my personal blog. I’ll share here my experience and my creativity. I’m a student who learned the mystery of the world. I want to conquered the unconquered, to see the unseen and learn moreover. I feel extra ordinary romance for that.

Let’s connect

Design a site like this with WordPress.com
Get started