আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন
– কাজী নজরুল ইসলাম

ঘুমাইয়া ছিল আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন,
বহু বৎসর মুখ চেপে ছিল পাষাণের আবরণ।
তার এ ঘুমের অবসরে যত ধনলোভী রাক্ষস
প্রলোভন দিয়ে করেছিল যত বুদ্ধিজীবীরে বশ।
অর্থের জাব খাওয়ায়ে তাদের বলদ করিয়ে শেষে
লুঠতরাজের হাট ও বাজার বসাইল সারা দেশে।
সেই জাব খেয়ে বুদ্ধিওয়ালার হইল সর্বনাশ,
‘শুদ্ধি স্বামী’ ও ‘বুদ্ধু মিয়াঁ-র হইল তাহারা দাস!
বুঝিল না, এই শুদ্ধি স্বামী ও বুদ্ধু মিয়াঁরা কারা
খাওয়ায় কাগুজে পুরিয়ায় পুরে এরাই আফিম, পারা!
সাত কোটি বাঙালির সাত জনে শুধু টাকা দিয়ে
দাস করে, এরা হল কোটিপতি বাঙালি রক্ত পিয়ে।
কাগুজে মগুজে ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিবলে,
ছুরি আর লাঠি ধরাইয়া দিল বাঙালির করতলে।
জানে এরা ভায়ে ভায়ে হেথা যদি নাহি করে লাঠালাঠি,
কেমন করিয়া শাঁস শুষে খাবে, ইহাদের দিয়া আঁটি?
আঁটি খেয়ে যবে ভরে নাকো পেট, শূন্য বাটি ও থালা,
বাঙালি দেখিল এত পাট, ধান, মেটে না ক্ষুধার জ্বালা!
তখন বিরাট আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবনে
নাড়া দিয়া যেন জাগাইয়া দিল ঝঞ্জা প্রভঞ্জনে!
জেগে উঠে দেখে রক্তনয়নে আগ্নেয়গিরি একী!
ওরই ধান ওরই বুকে কুটিতেছে বিদেশি কল ও ঢেঁকি!
উহারই বিরাট অঙ্গে উঠেছে মিলের চিমনিরাশি,
উহারই ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে হয়েছে আঁখির দৃষ্টি, হাসি।
এ কোন যন্ত্রদৈত্য আসিয়া যন্ত্রণা দেয় দেহে?
দাসদাসী হয়ে আছে নরনারী স্বীয় পৈতৃক গেহে।
একী কুৎসিত মূর্তিরা ফেরে আগুনের পর্বতে,
ক্যাঙালির মতো, বাঙালি কি ওরা – লেজ ধরে চলে পথে?
ভুঁড়ি-দাস আর নুড়ি-দাস যত মুড়ি খায় আর চলে,
যে-কথা উহারা বলাইতে চায়, চিৎকার করে বলে!
বিদারিত হল বহ্নিগিরির মুখের পাষাণভার,
কাঁপিয়া উঠিল লোভীর প্রাসাদ ভীম কম্পনে তার!
ক্রোধ হুংকার ওঠে ঘন ঘন প্রাণ-গহ্বর হতে,
‘লাভা’ ও অগ্নিশিখা উঠে ছুটে উর্ধ্ব আকাশপথে।

কই রে কই রে স্বৈরাচারীরা বৈরী এ বাংলার?
দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনিকো প্রবলের মার!
দেখেছ বাঙালি দাস, দেখনিকো বাঙালির যৌবন,
অগ্নিগিরির বক্ষে বেঁধেছ যক্ষ তব ভবন!
হেরো, হেরো, কুণ্ডলী-পাক খুলি আগ্নেয় অজগর
বিশাল জিহ্বা মেলিয়া নামিছে ক্রোধ-নেত্র প্রখর।
ঘুমাইয়া ছিল পাথর হইয়া তার বুকে যত প্রাণ,
অগ্নিগোলক হইয়া ছুটিছে তিরবেগে সে পাষাণ!
নিঃশেষ করে দেবে আপনারে আগ্নেয়গিরি আজি,
ফুলঝুরি-সম ঝরিবে এবার প্রাণের আতসবাজি!
ঊর্ধ্বে উঠেছে ক্রুদ্ধ হইয়া অদেখা আকাশ ঘেরি ;
তোমাদের শিরে পড়িবে আগুন, নাই বেশি আর দেরি!
তোমাদের যন্ত্রের এই যত যন্ত্রণা-কারাগার
এই যৌবনবহ্নি করিবে পুড়াইয়া ছারখার।
সুতি ধুতিপরা দেখেছ বিনয়- নম্র বাঙালি ছেলে,
ঢল ঢল চোখ জলে ছলছল একটু আদর পেলে!
দুধ পায় নাই, মানুষ হয়েছে শুধু শাকভাত খেয়ে,
তবুও কান্তি মাধুরী ঝরিছে কোমল অঙ্গ বেয়ে।
তোমাদের মতো পলোয়ান নয়, নয় মাংসল ভারী,
ওরা কৃশ, তবু ঝকমক করে সুতীক্ষ্ণ তরবারি!
বঙ্গভূমির তারুণ্যের এ রঙ্গনাটের খেলা
বুঝেও বোঝেনি যক্ষ রক্ষ, বুঝিবে সে শেষ বেলা!

শাড়ি-মোড়া যেন আনন্দ-শ্রী দেখো বাংলার নারী,
দেখনি এখনও, ওঁরাই হবেন অসি-লতা তরবারি!
ওরা বিদ্যুল্লতা-সম, তবু ওরাই বজ্র হানে,
ওরা কোথা থাকে, তোমরা জান না, সাগর ও মেঘ জানে।
যুগান্তরের সূর্য যখন উদয়-গগনে ওঠে,
সূর্যের টানে ছুটে আসে মেঘ ; তাহারই আড়ালে ছোটে
ওরা যেন ভীরু পর্দানশীন! ওরাই সময় হলে
ঘন ঘন ছোঁড়ে অশনি অত্যাচারীর বক্ষতলে!
শ্যামবঙ্গের লীলা সে ভীষণ সুন্দর, রেখো জেনে,
বাঘের মতন নাগের মতন দেখি, যে বাঙালি চেনে!
তাদেরই জড়তা-পাষাণ টুটিয়া ঝরিছে অগ্নিশিখা,
কে জানে কাহার তকদীরে ভাই কী শাস্তি আছে লিখা!
ধোঁয়া দেখে যদি না নোয়াও মাথা, বছর খানিক বেঁচো!
দেখিবে হয়েছি ফেরেশতা মোরা, তোমরা হয়েছ কেঁচো!

Leave a comment

I’m Mustakin Rahman

Welcome to Great poetry, This is my personal blog. I’ll share here my experience and my creativity. I’m a student who learned the mystery of the world. I want to conquered the unconquered, to see the unseen and learn moreover. I feel extra ordinary romance for that.

Let’s connect

Design a site like this with WordPress.com
Get started